ভৌতিক ও রহস্যময় গল্প
অদ্ভুতুরে রাত!!!
দাদীর কাছে সবসময় একটি লাল রঙা ডায়েরি দেখতে পেতাম। প্রতি রাতে কুপি জ্বালিয়ে তিনি ডায়েরি পড়তেন। সেই ডায়েরি তিনি কাউকে পড়তেও দিতেন না ধরতেও দিতেন না। হয়তো সেখানে তার ব্যক্তিগত পুরনো অনেক স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ রয়েছে অথবা আরও গোপনীয় কিছু। কেউ সেই ডায়েরিতে হাত দেওয়ার সাহস পেত না। কেউ ডায়েরি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেই ক্ষেপে যেতেন। ছোটবেলা থেকে এই দৃশ্য দেখে আমি অভ্যস্ত। গ্রামে বেড়াতে আসলে দাদীর সঙ্গ পেতে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো। বড় হওয়ার পর বুঝতে পারি আমার দাদী আর দশজনের মতো স্বাভাবিক না। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত আচরণ করতেন তখন কাছে যেতে একটু ভয় ভয় লাগতো। আমি ছোট থাকতে দাদীর অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে আমাকে কেউ কিছু খুলে বলেনি, ছোট মানুষ ভয় পাবো বলে।
.
গ্রামে আসতাম মাত্র ক'দিনের ছুটিতে, দাদীর ঘরে ঘুমাতাম, রুপকথার গল্প শুনতাম, দাদী এলোমেলো কাহিনী গুলো অসাধারণ ভাবে গুছিয়ে শোনাতে পারতেন, মনে হতো যেন সদ্য ঘটে যাওয়া জীবন্ত ঘটনা। একটা ব্যপার লক্ষ্য করতাম, দাদীর রুমে ঢুকলে সবাই আমাকে চোখে চোখে রাখতো, একটু পরপর কেউ না কেউ এসে দেখে যেতো। রাত বাড়লেই তিনি অনেকটা নিস্তব্ধ হয়ে যেতেন, বিড়বিড়িয়ে একাএকা কথা বলতেন, কখনো বাড়ির বাইরে চলে যেতেন। শহুরে মানুষেরা এটাকে সাইকোলজিক্যাল প্রব্লেম বলে সব উড়িয়ে দিলেও বাড়ির লোকজনেরা এক বাক্যে তাকে পাগল মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের দাবি জ্বীন পরীদের সাথে উনার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। সে যাই হোক, প্রথম যখন জানতে পেলাম তখন ক্লাস সিক্সে উঠেছি। তখন ভয়ের থেকে আগ্রহটাই বেশি জন্মে ছিল। দাদীর মুখ থেকে জ্বীন পরীদের কাহিনী যেসব গল্প হিসেবে শুনতাম সেসব ছিল সত্য কাহিনী। বড় হয়ে সব সত্য জানার পর তখন আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে বিস্তারিত শুনতে চাইতাম তখনই তিনি এসব এড়িয়ে যাওয়া শুরু করে দিলেন, এসব নিয়ে খুব বেশি আর মুখ খুলতেন না।
.
ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা শেষে বেশ লম্বা সময় হাতে পেয়ে যাই। ঘুরতে চলে যাই গ্রামের বাড়ি দাদীর কাছে। নিয়ত ছিল সপ্তাহ খানেক থাকবো। প্রথম ক'দিন খুব ভালভাবেই আনন্দে কেটে যায়। এরপর একে একে সমস্যার শুরু। গ্রামে নেট স্পিড সব স্থানে ভাল পাওয়া যেত না। সেই রাতে দাদীর ঘরে বসে বসে নেট চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ তিনি বিছানা থেকে উঠে আমার পাশে এসে বসলেন, হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাকে বলছেন..
--- কী রে.. ঘুমাস না?
--- না দাদী, একটু পর, কিছু বলবা?
চুপ করে মাথা নাড়লেন। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন..
--- ভালা একখান মাইয়া আছে, বিয়া করবি?! একদম হুর পরি। দেখলে শুধু চাইয়া থাকবি রে!
দাদীর মুখে এমন কথায় থমকে যাই, এই গ্রামে হুট করে কোত্থেকে এত সুন্দরী মেয়ে খুঁজে পেলো ! আমিতো এতদিন টর্চলাইট জালিয়েও খোঁজ পাইলাম না। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি..
--- কার মেয়ে? কোন বাড়ির মেয়ে?
--- এই মাইয়া সেই মাইয়া না রে নাতি.. এইডা হুরপরি! পরীর দেশের হেই পরী
বিয়ের কথা শুনে খুশিতে গদগদ হলেও এখন বুঝলাম উনার মাথা আবার আওলায় গেছে। ঘরিতে তাকিয়ে দেখি রাত দুইটা বাজে। টেবিলে ঘুমের ওষুধ খোলা পড়ে আছে। ওষুধ খেতে ভুলে গেলেই এমন উলোটপালোট শুরু হয়ে যায়। দাদীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওষুধ খাওয়ালাম। তিনি তার মতন করে বলেই যাচ্ছে.. "না কইরিস না, সুন্দরী তরে অনেক ভালা পায়, রাইতে তরে লুকায় লুকায় দেখতে আহে, ঘরের পিছে একলা বইসা থাকে সুযোগ পাইলে দেইখা আসিস"
দাদী একবার আজগুবী গল্প শুরু করলে আর থামেন না। আমি আচ্ছা আচ্ছা বলে ঘুম পাড়িয়ে কোনমতে আমার ঘরে ফিরে গেলাম।
.
কয়েকদিন পর বাড়ি ফেরার দিন ঠিক করে ফেলি, এমন সময় দাদী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। উনার কোমরের ব্যথা প্রচন্ড আকারে বেড়ে যায়, সাথে শ্বাসকষ্ট আছেই। বড় চাচা আর কয়েকটা দিন থেকে যেতে বলেন। আমিও আর মানা করলাম না। সেই রাতে আবারও নেটওয়ার্ক সমস্যায় ভুগছিলাম। দিনের বেলা ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটলেও রাতটা কোনভাবেই কাটতে চায় না। একা মানুষের একমাত্র সঙ্গী ইন্টারনেট, এটা ছাড়া চলবেই না। দাদীর ঘরে দরজা আর আমার দরজা পাশাপাশি, ঘরের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করা যায়। যাবো নাকি যাবো না ভাবছিলাম, দাদী অসুস্থ, বয়স্ক মানুষদের ঘুম এমনেতে অনেক হাল্কা, মোবাইলের আলোতে জেগে গেলে সমস্যা হবে, তাই শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয় নি। ইন্টারনেটের টানে বাহিরে উঠোনে এসে দাড়াই। একদম কড়কড়ে নেটওয়ার্ক। বাড়ির সীমানায় ভয়ের তেমন কিছু নেই। পাশেই চাচার ঘর। নিশ্চিন্ত মনে নেট ব্রাউজিং করে যাই।
.
হঠাৎ কেউ একজন পেছন থেকে আমায় ছুয়ে যায়! মুখ ফিরে তাকিয়ে দেখি দাদী উঠে এসেছেন, ইশারায় আমায় চুপ থাকতে বললেন। "তর চাচা জেগে উঠবে কথা বলিস না" আমিও চুপ মেরে রইলাম। দাদী কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন.. "দেখা করবি? কাছেই আছে, বাড়ির পেছনে"
কার সাথে?
সেদিন যে কইলাম... হুরপরী...
আমি তো ভুলেই গেছিলাম এখন আবারো সেই রাতের কথা মনে পড়লো। বুঝলাম আজও ওনার মাথা ভার হয়েছে।
"আচ্ছা দাদী করবো দেখা, আগে চলো ওষুধ খেয়ে নেও তোমাকে বিছানায় ঘুম পারিয়ে এরপর দেখা করবো, চলো চলো..ভেতরে আসো বাইরে অনেক ঠান্ডা পড়ছে"
দাদী হাত সরিয়ে নেয়, কথা না শুনে তবুও বলে যাচ্ছে "মাইয়াডা কত কষ্ট কইরা আইছে এইভাবে ফিরায় দিবি? ডরের কি আছে? আমি আছি না? চল আয় আমার লগে, এই ঘরের পেছনেই আছে"
.
দাদীর কথা প্রথম দিন উড়িয়ে দিলেও সেই মুহূর্তে অনেকটা বাস্তব মনে হচ্ছিলো। আর এসব বিষয় বাস্তব মনে হওয়া মানেই ভেতরে ভীতি অনুভব করা। আমি সাহসী ছেলে তাই বলে এতটাই সাহসী নই যে সত্যিকার পরীর সাথে দেখা করতে নাচতে নাচতে বাড়ির বাইরে চলে যাবো। পরী দুনিয়ায় আছে এইটুকুই বিশ্বাস করি এরবেশি কাহিনী গল্প গুজব ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না, কিন্তু সত্যিই যদি দাদীর আবোলতাবোল কথা সত্যি হয়ে যায়! তখন? না না বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যাবে না, ঘরে ফিরতে যাই। দাদীকে অনেক বুঝিয়েও ভেতরে নেওয়া যাচ্ছে না। উনি বলেই যাচ্ছেন "চল না একটু, দূরে যাইতে হইবো না, এই ঘরের পিছেই, আমি লগে আছি তো"
কিছুটা ভয়ের পাশাপাশি কৌতুহলটাও কম ছিল না, মনে হচ্ছিলো একটু এগিয়ে না হয় দেখেই আসি ঘটনা আসলে কি, দাদী তো পাশে আছে। যেই রাজি হয়েছি অমনি দাদী হাটা শুরু করলেন। হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরে গেলেন। ওনার ভাব মর্জি কিছুই বুঝলাম না। আমিও ঘরের ভেতরে ঢুকতে যেই আগালাম... কেউ একজন খুব কাছ থেকে বলে উঠলো... "একটু কথা বলবেন.....!"
মুখ ফিরিয়ে কাওকে না পেয়ে এই প্রথম সজ্ঞানে অদৃশ্য কিছুর অস্তিত্ব টের পেলাম। আমার পা তখন নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। দৌড় দেওয়ার শক্তি পাচ্ছিলাম না। অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। দ্বিতীয় বারের মতো বলে উঠলো "এই যে এই দিকে আমি......." অনেক মিহি কন্ঠস্বর, কোথায় যেন অনেক শুনেছি এই কন্ঠ। এমন কন্ঠে ফিসফিসিয়ে কথা বললেও কানে গিয়ে গাঁথে। মাথাটা চারিদিকে ঘুরালাম। দশ গজ দূরত্বে চাদর মুড়ি দেওয়া একটি মেয়ে চোখে পড়লো। আবছায়া অন্ধকারে টিউবওয়েল পাড় থেকে ডাকছে। চোখ পড়া মাত্র হাত ইশারায় কাছে ডাকলো। আকাশে চাঁদ থাকতেও আলো ছিল নিষ্প্রাণ, গাছগাছালি ভেত করে মেয়েটার উপর একবিন্দুও আলো পড়ছে না। আশেপাশের আলোতে শুধু দেহের আকৃতিটুক দেখতে পাচ্ছিলাম। ভয়ংকর কিছু লাগছিল না তবে গল্পে শুনেছি ভয়ংকরী হয়ে যেতে নাকি এদের সময় লাগে না। কি ঘটে সেখানে বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে কাঁধে কারো হাত এসে পড়লো, দাদী! অনেক শান্তি পেলাম, এই মানুষটা অনেক চুপিসারে যাতায়াত করতে পারে, দেখেই বুঝা যায় এটা তার বহু বছরের সাধনা। এভাবে তিনি মাঝেমধ্যে সকলের অগোচরে ঘরের বাহিরে রাত কাটান।
দাদী ফিসফিসিয়ে বলছেন..
"দাঁড়ায় আছিস কেন? আগায় যা... কেউ দেখবো না, আমি পাহাড়া দিতাছি, যা..."
আমার মাঝেও সাহস চলে আসে, একটা কিছু অনেক্ষণ তাকিয়ে দেখলে ভয়টা অনেক কেটে যায়, আমারও এমনটা হয়েছে, তারমধ্যে দাদী সজাগ আছেন। এগিয়ে যাই তার দিকে। কাছে আগাতে মেয়েটা উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকে। ধীর পায়ে খুব কাছাকাছি চলে আসি। চুপচাপ দাড়িয়ে। কি বলতে চায় শুনার অপেক্ষায় আছি।
.
মেয়েটা নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠে...
--- আপনি এতো ভিতু! পুরুষ মানুষ এতো ভিতু হয়? ছি ছি.. একটা মেয়ের কাছে আসতেই এই অবস্থা!
--- না মানে.. এমন মেয়ের সাথে কোনদিন তো অভিজ্ঞতা হয় নি, তাই একটু ভাবছিলাম
--- এমন মেয়ে মানে কি?? এই যে মিস্টার.. রাতের বেলা ডাকছি বলে খারাপ মেয়ে ভাবছেন নাকি? হিসেব করে কথা বলেন...!
--- আরে খা খা খারাপ বলবো কেন, আমি শুনেছি পরীরা নাকি অনেক ভালো হয়। আপনিও অনেক ভাল, কারো ক্ষতি করেন না তাইনা?
সে এক ঝটকায় আমার দিকে তাকায় ,
--- কি কইলেন? পরী? কে পরী? কিসের পরী?
--- দাদী যে বললো...
--- দাদী কি বলছে?
--- কোথাকার হুরপরী নাকি দেখা করতে চায় আমার সাথে
--- ঠিকই তো বলছে, হুর পরীই তো, দেখেন নাই আমারে? ওরে লজ্জাবতী পুরুষ রে... ডানে বায়ে তাকাইয়া কি দেখেন? এদিক চাইয়া একটু দেখেন আমারে...!
মেয়েটা দু'কদম সরে গিয়ে গাছের ছায়া ছাড়িয়ে চাঁদের আলোতে দাঁড়ায়, মোড়ানো চাদরটা মাথা থেকে সরিয়ে মুখোমুখি তাকিয়ে প্রশ্ন করে..
--- কী? হুরপরি লাগছে এবার??
আমি উপর নিচ মাথা নাড়ালাম, মন রক্ষার্তে নয়, একদম মন থেকেই। মেয়েটা সত্যিই মারাত্মক রূপবতী, চাদের রুপালী আলোয় রূপের রঙ যেন পুরো দেহে খেলে বেড়াচ্ছে। আমি পুরোপুরি স্তব্ধ। কে এই মেয়ে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
--- আপনি আমাকে এতক্ষণ জ্বীন পরী ভাবছিলেন নাকি?!
আমি উপর নিচ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। মেয়েটি হাসতে হাসতে বসে পড়লো, ওহ আচ্ছা.. হা হা হা! আপনি তো দেখছি সত্যিই বীরপুরুষ! পরী ভেবেও দেখা করতে আসছেন!
--- দাদীর জন্যেই তো...
--- হি হি, দাদী যা বলছে তাই বিশ্বাস করে বসে আছেন!
পাড়ার সকলেই তারে চিনা ফেলছে, নিজ দাদীরেই আপনি এখনও চিনেন নাই?!
--- প্রথমে বিশ্বাস করিনি বলেই সব কথা উড়িয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু এখনতো দেখছি সত্যিই কেউ দেখা করতে এসেছে, তাও আবার জ্বল জ্যান্ত মানুষ
--- হুম, সত্যি বলতে আপনার সাথে দেখা করার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের। আপনার গ্রামে আসার কোনো খবর নেই আমারও দেখা করার উপায় নেই, বছরে দুই একবার বাড়ি আসেন, দূর থেকে শুধু দেখে যাই। কাছে দেখার সুযোগ হয়ে উঠে না। দাদীর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত আজ কাছে পেলাম।
--- আচ্ছা, আপনি কোন বাড়ির মেয়ে?
--- বাড়ির মেয়ে না, বাড়ির বউ আমি
--- বউ! কার বউ?!
--- পরিচয় শুনেতো এবার ভয় পেয়ে যাবেন, আগে আড়ালে আসুন কেউ দেখে ফেললে বিপদ হয়ে যাবে
হেঁটে হেঁটে বাড়ির পেছনে চলে গেল, আমিও তার পিছু পিছু এগিয়ে যাই।
.
বাড়ির পেছনে একটি গাছের গুড়ির উপর বসে পড়লো
--- জানেন এই জায়গাটা আমার অনেক প্রিয়, মন খারাপ থাকলে রাতে এসে বসে থাকি, জোনাক পোকাদের সাথে কথা বলতে বলতে নিস্তব্ধতায় ডুবে যাই৷ কখনো আপনার দাদীও সুযোগ পেলে চলে আসে, একত্রে গল্প করে কত রাত যে কাটিয়েছি হিসেব নেই।
খোশগল্পে আমার তেমন একটা আগ্রহ না পেয়ে আগের কথায় ফিরে যায়..
--- কি যেন বলছিলাম তখন?
--- আপনার পরিচয় নিয়ে
--- ও হ্যা, আমি পাশের বাড়ির বউ
--- কার বউ?
--- আপাতত ইমাম সাহেবের বউ
--- কোন ইমাম? মানে আপনি আমাদের হজুরের বউ! ??
--- জ্বী মশাই, হজুরের বউ
--- বউ আবার আপাতত হয় কি করে?
মুচকি হেসে....
--- ইয়ে মানে... কাল আপনারো তো হতে পারি!
--- কিহ!
--- হাহা,, সত্যিই আপনি অনেক ভাল ছেলে, আপনাকে আমার অনেএএক ভাল লাগে। দাদী এই কথা জানার পর তিনি কাছ থেকে দেখা করানোর আশ্বাস দেয়। বহু প্রতীক্ষার পর আজ সেই দেখাটা পেয়েই গেলাম।
আমি জোসনার আলোয় তাকিয়ে দেখি হজুরের বউয়ের এই হাল! পর্দার বালাই নাই, জামাকাপড়ের ঠিক নাই, মাথায় নিশ্চয়ই সমস্যা আছে মনে হচ্ছে, একটু রেগে বললাম..
--- আপনি একজন হজুরের বউ হয়ে এই মাঝ রাতে বাহিরে ! তাও একটা ছেলের সাথে দেখা করতে!
মেয়ে তিন গুণ রাগ দেখিয়ে বলে উঠে..
--- হজুরের বউ হইছি তো কি হইছে? সব কি তারে বেইচ্চা দিছি নাকি? আমার কি সাদ আহ্লাদ নাই? সারাদিন একা বাড়িতে ফালাইয়া রাখে, সারা রাইত বেডার নাক ডাকার শব্দ শুইনা রাত কাটাই। এইটা কোনো জীবন হইল?
মেয়ে পাগল কিনা জানিনা তবে তার বার্তা গুলি খুব একটা ভালো ঠেকছে না। তারমধ্যে সে অন্যের বউ, যেন তেন মানুষের বউ না.. হজুরের বউ! আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ি ফিরে যেতে নেই, খপ করে আমার হাত ধরে ফেলে..! মায়াবী কন্ঠে বলে.. "আরেকটু থাকলে হয় না? আসেননা আরেকটু গল্প করি.." উত্তর না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে দ্রুত চলে আসি।
বাড়ি এসে দরজা আটকে দেই।
.
দরজা আটকানোর শব্দে দাদী বলে উঠেন.. "মাঝ রাইতে দরজা খুলস কেন? আইজ রাইত ভালা না, একলা বাইরে যাইস না!"
আমি বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাত্রই তো দাদী নিজেই বের হয়েছিল। পরক্ষণে মনে পড়ে গেল দাদীতো মাজার ব্যাথায় দুইদিন ধরে ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারে না। নিঃশব্দে উঠলো কি করে? তাহলে! একটু আগে দাদী রূপে কে ছিল সাথে! হাত পা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আসে।
দেরী না করে দ্রুত দাদীকে সবকিছু খুলে বলে দেই। তিনি কথা না বলে মাথা নাড়লেন। হজুরের বউ নিয়ে জিজ্ঞাস করাতেও উত্তর দিলেন না। তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না তাই আমাকে আলমারি থেকে লাল ডায়েরিটা বের করে আনতে বললেন। ডায়েরি হাতে নিয়ে এবার আমাকে কিছু কথা বললেন...
"এই ডায়েরি হাতে নিয়া যখন আমারে কথা কইতে দেখবি তখন একমাত্র নিশ্চিত হইবি আমি তর আসল দাদী, তখন যা বলি তাই শুনবি, ডায়েরি হাতে নেওয়া ছাড়া কিছু করতে বললে সেটা কখনওই করবি না, আমি তোর দাদী এখনো বাঁইচা আছি কিন্ত বাচার মতন নাই রে, আমি আমার মধ্যে সব সময় চাইলেও থাকতে পারি না। যাহ ঘুমিয়ে পর, দেখতেছি আমি তার এত বড় সাহস কেমনে হইলো আমার নাতির দিকে হাত বাড়ায়! দুইদিন অসুস্থ দেইখা এত সুযোগ পাইয়া বইছে, আইজ খবর আছে সব গুলার"
.
আমি আমার মতো ঘরে এসে শুয়ে পড়ি। রাতে ভয়ংকর বিদঘুটে স্বপ্নে মাথাটা গুলিয়ে আসে। প্রচন্ডরকম মাথা ব্যথা কিন্তু কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে পারছি না। স্বপ্নে দেখি দাদীকে দড়ি দিয়ে পেচিয়ে বেঁধে রাখা হইছে, দুটো কালো হাত দাদীর মুখ চেপে ধরে আছে। দাদী আমাকে কিছু একটা বলছে কিন্তু শুনতে পাচ্ছি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। আনুমানিক ভোর ছয়টা বাজে। বাড়ির বাইরে থেকে বেশ হইচইয়ের শব্দ ভেসে আসছে। তাকিয়ে দেখি দাদী ডায়েরি হাতে আমার পায়ের কাছে বসে আছেন। জেগে উঠতেই বলে উঠেন.. এখনই শহরে ফিরে যা, দেরি করিস না, হজুরের বউডা আর নাই! আমি কিছুই বুঝলাম না। তিনি ঘরের পেছনের জানালা খুলে দিলেন। জানালার কাছে গিয়ে দেখি চারিদিকে মানুষের ভীর, গাছে এলোমেলো শাড়ি জড়ানো লাশ ঝুলছে, হজুরের বউয়ের লাশ! ঠিক যে যায়গাটায় শেষ কথা বলে এসেছিলাম ঠিক সেইখানে। আশেপাশে মানুষের বলাবলি কথা শুনে বুঝলাম মেয়েটা অনেকদিন ধরে মানসিক রোগী ছিল, ঘরের বাইরে বের হতো না। হজুর অনেকদিন কবিরাজি চিকিৎসা করেও ভাল করতে পারেনি।
.
দাদী কোমর ব্যথা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন, কাঁধে হাত রেখে বললেন.. "পরীডা অনেক ভালা রে, এখন আর সে হজুরের বউ নাই! এখন সে একেবারে মুক্ত! বিয়াটা কইরা ফেল, অনেএএক সুখে থাকবি তুই!" দাদীর কথায় স্তব্ধ হয়ে যাই। খেয়াল করে দেখি দাদীর হাতে ডায়েরিটা নেই, আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ডায়েরি টেবিলে উলটে পড়ে আছে। ডায়েরির দিকে আগাতেই অমনি উনি আমার গলা টিপে ধরেন! বিদঘুটে গন্ধ বের হচ্ছে শরীর দিয়ে, ভয়ংকর পুরুষালি কন্ঠে বলছেন.. মর তুই মর মর মর তুই... মুখ থেকে গলগলিয়ে পানের পিক বেয়ে পড়ছে... প্রচন্ড দুর্গন্ধ।
আমি কোনমতে নিজেকে ছাড়িয়ে ডায়েরি হাতে নেই, দাদীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে উনাকে বিছানায় নিয়ে আসি। কিছুক্ষণ বাদে শান্ত হয়, জ্ঞান ফিরে আসে তার। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন.. "এখনো যাস নাই? চলে যা, যায়গাটা এখন ভালা না তর জন্যে"
আমি মাথা নেড়ে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নেই। বিদায়ের সময় দাদী কাঁদছেন, আমি মুরুব্বীদের সচারচর এভাবে কাঁদতে দেখি না, তারা অনেক শক্ত থাকেন কিন্তু তিনি কান্না থামাতে পারছেন না। বুঝা যাচ্ছে অনেক বাজে কিছু হতে চলছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মুখে ক্ষণিকের হাসি ফুটিয়ে বলেন কোনো ভয় পাবি না, আমার জান দিয়ে হলেও তর কিচ্ছু হইতে দিমু না। আমার যদি কোনোদিন কিছু হয়ে যায় এই ডায়েরিডা তুই নিজ হাতে নদীতে ডুবাইয়া দিবি। আর কাউরো হাতে যেন না পড়ে। যা এখন... ভালা থাকিস। আমি সালাম করে বের হয়ে গেলাম।
.
ঠিকঠাক বাসায় ফিরে আসি ঠিকই কিন্তু কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। এভাবে একদিন দুই দিন পার হতে থাকে আর আমার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। একটা রাতেও ঘুমাতে পারিনি। দিনে এক প্লেট ভাত পর্যন্ত পেটে ঢুকাতে পারিনি, পানি খেয়ে কোনোমতে টিকে ছিলাম। বাসার সবার টেনশন বেড়ে যায়। চোখ বন্ধ করতেই কেমন যেন ভিন্ন জগৎ চোখে ভেসে উঠে। ভয়ে চোখটাও আর বন্ধ করতে চাইতাম না। ঠিক সাত দিনের দিন সকালে প্রচন্ড ক্ষুধায় ঘুম ভেঙে যায়। উঠেই দেখি আম্মু আব্বু দুজনেই সাত সকালে উঠে বসে আছেন। তারাও আমার চিন্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। খাবার খেতে চাইলে আম্মু ভাত নিয়ে আসেন। সবাই কেমন যেন অনেক চুপচাপ। আমি পেটপুরে গপাগপ খেয়ে নেই সব। অনেকটাই সুস্থ অনুভব করছি। অনেকটা বললে ভুল হবে, বলতে গেলে তখন পুরোপুরি সুস্থ আমি। এমন সময় আম্মু পাশে বসে কেঁদে উঠে বলেন... তোর দাদী আর নেই।
0 Response to "ভৌতিক গল্প।"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন